পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারি কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে রাজ্য সরকারের কাছে দাবী জানিয়ে আসছে তাদের বকেয়া মেটানোর জন্য। এই পরিপ্রেক্ষিতে তারা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন অনশন এবং আইনি পদক্ষেপ নিয়েছে। অবশেষে সুপ্রিম কোর্টের তরফ থেকে রায় দিয়ে বলা হয়েছে রাজ্য সরকারি কর্মীদের বকেয়া মিটিয়ে দিতে এবং তাদের ২৫% হারে DA দিতে। সুপ্রিম কোর্ট রায় দেওয়ার পরেও রাজ্য সরকার এখনো পর্যন্ত সেই রায় কার্যকর করেনি। এই পরিস্থিতিতে ‘কনফেডারেশন অফ স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ, ওয়েস্ট বেঙ্গল’ রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা (Contempt of Court) করেছে।
সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিলেও রাজ্য সরকার কেন এখনো তাদের বকেয়া DA সহ ২৫% DA মিটিয়ে দিচ্ছে না এই নিয়ে একটি বিতর্ক তৈরি হয়েছে। তবে সেই মামলার নথিতে একটি বড় ত্রুটি ধরা পড়ায় নতুন বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এমনকি সেই ভুল এসেছে সরকারি কর্মীদের পক্ষ থেকেই। চলুন জানি কী সেই ত্রুটি, কী প্রভাব পড়তে পারে মামলায়, এবং এখন কোথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে বকেয়া DA বিতর্ক।
আদালত অবমাননার নোটিশ: কোথায় কী ভুল হল?
‘কনফেডারেশন অফ স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ’ গত ৩০ জুন, ২০২৫ তারিখে নবান্নে গিয়ে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার নোটিশ প্রদান করে। সুপ্রিম কোর্টের তরফ থেকে চার সপ্তাহ সময় দেওয়া হলেও এখনো সেই সময় পার হয়ে গিয়েছে কিন্তু রাজ্য সরকারি কর্মীরা তাদের ২৫% DA পাইনি। অভিযোগ ছিল, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও ২৫% বকেয়া DA এখনো পর্যন্ত কর্মীদের দেওয়া হয়নি।
তবে এই নোটিশেই ছিল একটি চরম ভুল— রাজ্যের মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ-এর নামের বানানে গলদ ছিল। এত বড় এক আইনি প্রক্রিয়ায় এমন ভুল প্রশাসনিক ও আইনি দিক থেকে গুরুতর ধরা হয়। তবে পরবর্তীকালে এই ভুল সংশোধন করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। সরকারি কর্মচারীদের আশ্বস্ত করা হয়েছে যে নোটিশের আইনি গ্রহণযোগ্যতা এখন প্রশ্নসিদ্ধ হবে না।
সুপ্রিম কোর্টে রাজ্যের যুক্তি: বাজেট নেই, চাই আরও ৬ মাস
রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা সুপ্রিম কোর্টের রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করেছে। পাশাপাশি, বকেয়া DA মেটাতে আরও ৬ মাস সময় চাওয়া হয়েছে। বর্তমান রাজ্য সরকারের কাছে এই ডিএ দেওয়ার জন্য টাকা নেই। তাই রাজ্য সরকার আরো কিছুটা সময় চেয়ে নিচ্ছেন।
রাজ্য সরকারের যুক্তি:
- ২৫% বকেয়া DA মেটাতে বিশাল অর্থের প্রয়োজন। বর্তমান রাজ্যের সামর্থ্য নেই এই টাকা মেটানোর।
- বর্তমান অর্থবর্ষে সেই অর্থ বাজেটে বরাদ্দ নেই।
- সেই কারণেই রায় কার্যকর করতে সময় চাওয়া হয়েছে।
এই যুক্তিতে কর্মচারীদের অনেকেই একমত নন। তাঁদের মতে, এই বিলম্ব কৌশলগত এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। রাজ্য সরকার উদ্দেশ্য প্রণীতভাবে দেরি করছে।
সরকারি কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ
এই পরিস্থিতিতে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ ছড়িয়েছে। তাঁদের দাবি, সুপ্রিম কোর্টের স্পষ্ট রায় থাকা সত্ত্বেও রাজ্য সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে DA দিতে দেরি করছে এর পিছনে রাজ্য সরকারের নিশ্চয়ই কোন উদ্দেশ্য রয়েছে। সুপ্রিমকোর্টকে রাজ্য সরকার অবমাননা করতে পারে এর পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য সরকারি কর্মীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ ও ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।
কর্মীদের বক্তব্য:
- আদালতের রায় মানা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব।
- শুধু সময় চেয়ে বারবার রায় কার্যকর না করা আইনবিরুদ্ধ।
- অবিলম্বে DA মেটানোর জন্য আন্দোলন জোরদার হবে।
বকেয়া DA বিতর্কের পটভূমি
এই বকেয়া DA বিতর্ক দীর্ঘদিনের। দীর্ঘদিন ধরে রাজ্য সরকারি কর্মীরা আন্দোলন অনশন করে আসছে এর জন্য। মূলত পঞ্চম বেতন কমিশন অনুসারে বকেয়া DA’র একটি বড় অংশ এখনো বাকি। বিভিন্ন সময় সংগঠনগুলো আইনি পদক্ষেপের হুমকি দিলেও, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরেও বাস্তবায়নে বিলম্ব হয়েছে। রাজ্য সরকারি কর্মীদের একাংশ মনে করছেন রাজ্য সরকারের নিশ্চয় কোন উদ্দেশ্য রয়েছে এর পিছনে।
মূল সময়রেখা:
- ২০২৩: কর্মচারীদের তরফে সুপ্রিম কোর্টে মামলা।
- মার্চ ২০২৪: সুপ্রিম কোর্ট DA মেটাতে নির্দেশ দেয়।
- ২০২৫ জুন: DA না মেটানোয় অবমাননার মামলা।
মামলা কি প্রভাব ফেলবে এই ভুলের জন্য?
আইনি বিশেষজ্ঞদের মতে, বানান ভুল যেহেতু পরে সংশোধন করা হয়েছে এবং মূল বিষয়বস্তু অপরিবর্তিত আছে, তাই মামলার উপর বড় প্রভাব পড়বে না। তবে সরকার এই ভুলকে কাজে লাগিয়ে মামলা বিলম্বিত করার চেষ্টা করতে পারে, এমন আশঙ্কাও রয়েছে।
আইনি দিক:
- অপনাম সংশোধনযোগ্য, তাই মামলার গ্রহণযোগ্যতা বাতিল হবে না।
- তবে, সরকার পক্ষ এটি প্রক্রিয়াগত ত্রুটি হিসেবে দেখিয়ে সময় চাওয়ার সুযোগ পেতে পারে।
২৫% বকেয়া DA কত টাকা?
ধরুন একজন কর্মচারীর মূল বেতন ৩০,০০০ টাকা।
বেতন | DA হার | DA পরিমাণ |
---|---|---|
৩০,০০০ টাকা | ২৫% (বকেয়া) | ₹৭,৫০০ টাকা |
একজন কর্মচারীর প্রতি মাসে গড়ে ৭,৫০০ টাকা করে বকেয়া DA প্রাপ্য। বছরে ১২ মাস ধরলে, এই অঙ্ক ₹৯০,০০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। লক্ষাধিক কর্মচারীর এই পাওনা নিয়ে রাজ্য সরকারের দায়বদ্ধতা বিশাল।
এখন কী হতে পারে?
সম্ভাব্য পরবর্তী ধাপ:
- সুপ্রিম কোর্ট আগামী শুনানিতে রায় কার্যকর না হওয়ার কারণে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে গম্ভীর অবস্থান নিতে পারে।
- আর্থিক জরিমানা, এমনকি আদালত অবমাননার শাস্তিও হতে পারে।
- রাজ্য সরকার সমঝোতার রাস্তায় আসার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
পশ্চিমবঙ্গের DA ইস্যু এখন আর শুধু আর্থিক বা প্রশাসনিক নয়, এটি একটি সংবেদনশীল সামাজিক ও আইনি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারি কর্মীরা দিনের পর দিন ন্যায্য পাওনার জন্য অপেক্ষা করছেন। এবার যদি সুপ্রিম কোর্ট কঠোর অবস্থান নেয়, তবে রাজ্য সরকার বাধ্য হবে সিদ্ধান্ত নিতে। তবে রাজ্য সরকার যে সুপ্রিম কোর্টের রায় অবমাননা করেছে এর জন্য সুপ্রিম কোর্টের তরফ থেকে বড় কোন পদক্ষেপ নিতে পারে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে।
শেষ কথা — DA শুধু একটা সংখ্যা নয়, এটি বহু সরকারি কর্মীর ন্যায্য অধিকার। তাই এর দ্রুত নিষ্পত্তিই হোক সকল পক্ষের কাম্য।