দেশজুড়ে যখন জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া, তখন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের জন্য বিদ্যুৎ বিল হয়ে উঠছে এক ভয়ানক বোঝা। তবে এবার সেই বোঝা অনেকটাই হালকা হতে চলেছে। কারণ, সরকারের তরফে ঘোষণা করা হয়েছে একটি নতুন প্রকল্প— Free Bijli Yojana 2025, যার আওতায় রাজ্যের প্রায় ১.৮২ কোটি গ্রাহক পাবে বিনামূল্যে ১২৫ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ।
কি এই Free Bijli Yojana 2025?
সরকারি সূত্র অনুযায়ী, এই প্রকল্পের আওতায় প্রত্যেক গৃহস্থালি বিদ্যুৎ গ্রাহক আগামী দিনে প্রতি মাসে ১২৫ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিনামূল্যে ব্যবহার করতে পারবেন। কেউ যদি এর বেশি ইউনিট ব্যবহার করেন, তাহলে তাঁকে কেবলমাত্র অতিরিক্ত ইউনিটের দামই দিতে হবে। অর্থাৎ প্রথম ১২৫ ইউনিটে কোনও বিল আসবে না।
কারা এই প্রকল্পের সুবিধা পাবেন?
এই সুবিধা দেওয়া হবে সব গৃহস্থালি গ্রাহকদের — শহর হোক বা গ্রাম, বড় বাড়ি হোক বা ছোট ঘর। যদি আপনার বাড়িতে বৈধ গৃহস্থালি বিদ্যুৎ সংযোগ থাকে এবং আপনি মাসে ১২৫ ইউনিট বা তার কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন, তাহলে এই প্রকল্পে আপনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে অন্তর্ভুক্ত হবেন।
আলাদা করে কোনও আবেদনপত্র জমা দেওয়ার প্রয়োজন হবে না।
কতজন পাবেন এই প্রকল্পের সুবিধা?
সরকারের হিসেবে, প্রথম ধাপে এই প্রকল্পে ১.৮২ কোটি গ্রাহক সরাসরি উপকৃত হবেন। ভবিষ্যতে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে, কারণ বিভিন্ন পরিবার এখন বিদ্যুৎ ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণে এনে এই স্কিমের সুবিধা নিতে আগ্রহী হবেন।
কেন এই প্রকল্প চালু করল সরকার?
বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ প্রতিমাসে বিদ্যুৎ বিল দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। খাদ্য, জ্বালানি, পরিবহন— সবকিছুর দাম চড়েছে। এক্ষেত্রে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ প্রকল্প হল সরকারের তরফে এক বড় রিলিফ মুভ। এর ফলে—
- মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর মাসিক খরচ কমবে।
- বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে উৎসাহ বাড়বে।
- গ্রাহকরা মিতব্যয়ীভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে শিখবেন।
- পরিবেশ সুরক্ষায়ও একটা ইতিবাচক ভূমিকা নেবে।
কবে থেকে চালু হবে এই স্কিম?
যদিও এখনো পর্যন্ত সরকার আধিকারিক ভাবে কোনও নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করেনি, তবে বিদ্যুৎ দপ্তর সূত্রে খবর— আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এই প্রকল্প চালু হতে পারে। এখন চলছে নিয়মনীতি ও প্রযুক্তিগত প্রস্তুতির কাজ।
কিভাবে পাবেন সুবিধা? কী করতে হবে?
এই প্রকল্পের জন্য আলাদা করে কোনও আবেদন করতে হবে না।
- যাদের বৈধ গৃহস্থালি সংযোগ রয়েছে,
- যারা মাসে ১২৫ ইউনিট বা তার কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন,
তাঁদের বিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে শূন্য (₹0) হয়ে যাবে।
সরকার এই প্রক্রিয়াকে পুরোপুরি অটোমেটেড করতে চাইছে যাতে গ্রাহকদের হয়রানির মুখে না পড়তে হয়।
বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের কৌশল: ১২৫ ইউনিটে কিভাবে চালাবেন মাস?
এই প্রকল্পে উপকৃত হতে হলে আপনাকে বিদ্যুৎ ব্যবহারে একটু সচেতন হতে হবে। নিচে কিছু পরামর্শ দেওয়া হল:
- এলইডি বাল্ব ব্যবহার করুন (৬০-৭০% বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয়)
- দিনের আলোয় কাজ করুন, অপ্রয়োজনে লাইট বন্ধ রাখুন
- ফ্রিজ, ফ্যান, টিভি ইত্যাদি চলমান অবস্থায় রেখে বাইরে না যান
- ইনভার্টার বা বিদ্যুৎ চোর যন্ত্রপাতি ব্যবহার এড়িয়ে চলুন
- প্রাকৃতিক আলো ও বাতাস ব্যবহার করুন
উদাহরণ হিসেবে ধরুন:
একটি সাধারণ পরিবারের বিদ্যুৎ খরচ (মাসে):
যন্ত্রপাতি | দৈনিক সময় | মাসিক ইউনিট (প্রায়) |
---|---|---|
ফ্যান – ২টা | ১৬ ঘণ্টা | 36 ইউনিট |
LED লাইট – ৪টা | ৬ ঘণ্টা | 8 ইউনিট |
ফ্রিজ | ২৪ ঘণ্টা | 30 ইউনিট |
টিভি | ৪ ঘণ্টা | 12 ইউনিট |
মোবাইল চার্জিং + Wi-Fi | – | 5 ইউনিট |
মোট ইউনিট | – | 91 ইউনিট |
👉 দেখা যাচ্ছে, একটু সচেতন থাকলে ১২৫ ইউনিটে অনায়াসেই মাস কাটানো সম্ভব।
এটা শুধু ফ্রি বিদ্যুৎ নয়, একটা রূপান্তরের সুযোগ
Free Bijli Yojana 2025 শুধুমাত্র একটি “ফ্রি সুবিধা” নয়, বরং এটা একটি পরিবর্তনের পদক্ষেপ — যাতে মানুষ বিদ্যুৎ সাশ্রয় শিখে, স্মার্ট কনজাম্পশনে অভ্যস্ত হয় এবং পরিবেশবান্ধব হয়ে ওঠে।
সরকারের এই পদক্ষেপে যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়, তাহলে আগামী দিনে এই স্কিম হবে অন্যান্য রাজ্যগুলোর জন্যও রোল মডেল
আরও পড়ুন
পশ্চিমবঙ্গের ডিএ (মহার্ঘ্য ভাতা) বিতর্ক বিগত কয়েক বছর ধরেই রাজ্যের সরকারি কর্মচারীদের এক গভীর অসন্তোষের কেন্দ্রে রয়েছে। ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত এসে পরিস্থিতি এক চরম উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছেছে। কলকাতা হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে একাধিক শুনানি, রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবায়নে গড়িমসি — সবকিছু মিলিয়ে রাজ্যের চাকরিজীবীদের মধ্যে এক প্রবল ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। কনফেডারেশন সহ বিভিন্ন কর্মচারী সংগঠন আবারো নতুন কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দিয়েছে, আর তা রাজ্য প্রশাসনের উপর নতুন করে চাপ তৈরি করেছে।
কী নিয়ে এই মামলা? — মূল বিষয়বস্তু
ডিএ মামলার মূল বিষয় হল, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কর্মচারীদের কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘ্য ভাতা না দেওয়া। যেখানে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীরা ৪৬% হারে ডিএ পাচ্ছেন, সেখানে রাজ্য সরকার এখনো মাত্র ৩-৪% হারে ডিএ প্রদান করছে। কর্মচারীদের অভিযোগ, এটি সরাসরি বৈষম্যমূলক আচরণ এবং সংবিধানবিরোধী।
২০১৬ সালে এই বিষয়ে প্রথম মামলা দায়ের করা হয় এবং ২০২২ সালে কলকাতা হাইকোর্ট রায় দেয় যে, ডিএ হচ্ছে ‘কোনো দয়া নয়, এটি কর্মচারীদের অধিকার’। কিন্তু সেই রায় কার্যকর করতে রাজ্য সরকার নানা অজুহাত দেখিয়ে বিলম্ব করে চলেছে।
আদালতের অবস্থান ও রাজ্যের টালবাহানা
কলকাতা হাইকোর্ট এবং পরবর্তীতে সুপ্রিম কোর্ট বারবার রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে ডিএ নিয়ে স্বচ্ছতা বজায় রাখার এবং কেন্দ্রীয় হারে ডিএ প্রদানের দিক নির্দেশনা নিতে। কিন্তু রাজ্য সরকার প্রতিবারই অর্থনৈতিক সংকট, কোভিড পরিস্থিতি এবং অন্যান্য প্রশাসনিক সমস্যার অজুহাতে এই নির্দেশকে কার্যকর করছে না।
২০২৫ সালের মে মাসে আবারো সুপ্রিম কোর্টে এই মামলার শুনানি হয়। আদালত রাজ্যকে জানায়, তারা যদি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে ডিএ প্রদান সংক্রান্ত রূপরেখা না দেয়, তবে আদালত কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে।
তবে আশ্চর্যের বিষয়, এত কিছুর পরও এখনো পর্যন্ত রাজ্য সরকার একটি নির্দিষ্ট রূপরেখা আদালতে পেশ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
ডিএ-তে পিছিয়ে পশ্চিমবঙ্গ, অন্য রাজ্যের তুলনা
রাজ্য | ডিএ শতাংশ (২০২৫) | মন্তব্য |
---|---|---|
পশ্চিমবঙ্গ | ৩%-৪% | রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় হারে মানে না |
মহারাষ্ট্র | ৪৬% | কেন্দ্রীয় হারে ডিএ প্রদান |
বিহার | ৪৬% | কেন্দ্রের সাথে তাল মিলিয়ে চলা |
কেরল | ৪৫% | প্রতি ছয় মাস অন্তর ডিএ সমন্বয় |
উত্তরপ্রদেশ | ৪৬% | কেন্দ্রীয় নিয়ম অনুসরণ |
এই তালিকাটি স্পষ্ট করে দেয়, রাজ্য সরকার যে ‘অর্থ নেই’ বলে যে ব্যাখ্যা দিচ্ছে তা আদৌ যুক্তিসম্মত নয়। অনান্য রাজ্য যারা পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তারাও কেন্দ্রীয় হারে ডিএ প্রদান করতে পারছে।
কর্মচারীদের বক্তব্য ও আন্দোলনের রূপরেখা
রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের একাধিক সংগঠন যেমন কনফেডারেশন অব স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ, সরকারি কর্মচারী ফেডারেশন, ও ডিএ সংগ্রামী মঞ্চ বারবার দাবি জানিয়ে আসছে যে, রাজ্য সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে কেন্দ্রীয় হারে ডিএ দিচ্ছে না।
২০২৫ সালের জুলাই মাসে কনফেডারেশন এক সাংবাদিক সম্মেলনে জানায়:
“আমরা দীর্ঘ ছয় বছর ধরে ডিএ-এর জন্য লড়াই করছি। আদালতের রায় আমাদের পক্ষে, কিন্তু রাজ্য সরকার অসাংবিধানিকভাবে আমাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। অগাস্টে আমরা বৃহত্তর কর্মবিরতি ও ধর্ণার প্রস্তুতি নিচ্ছি।”
তাদের মতে, এই আন্দোলন শুধু আর্থিক অধিকার নয়, বরং ন্যায়ের দাবিতে এক সম্মিলিত প্রতিবাদ।
অর্থনৈতিক বাস্তবতা বনাম প্রশাসনিক ব্যাখ্যা
রাজ্য সরকারের বক্তব্য হলো, তারা রাজস্ব ঘাটতির মধ্যে রয়েছে এবং এত বড় অঙ্কের ডিএ একসাথে দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, যেখানে রাজ্য নানা রাজনৈতিক প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে, সেখানেই বা কর্মচারীদের ন্যায্য পাওনা কেন আটকে রাখা হচ্ছে?
বিভিন্ন অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, ডিএ মূলত কর্মচারীদের খরচ সামলানোর জন্য দেওয়া হয়, এটি বিলাসিতা নয়। তাই এটি না দিলে কর্মদক্ষতায় প্রভাব পড়ে এবং প্রশাসনিক কাঠামো দুর্বল হয়।
ভবিষ্যতের সম্ভাব্য দিক
ডিএ মামলার ভবিষ্যৎ পুরোপুরি নির্ভর করছে সুপ্রিম কোর্টের পরবর্তী রায় ও রাজ্য সরকারের অবস্থানের উপর। যদি আদালত আরও কঠোর অবস্থান নেয়, তাহলে রাজ্য সরকার বাধ্য হতে পারে ডিএ দেওয়ার রূপরেখা দিতে।
অন্যদিকে, যদি রাজ্য সরকার আবারো বিলম্ব করে, তাহলে কর্মচারীদের মধ্যে অস্থিরতা আরও বাড়বে এবং আগামী বিধানসভা নির্বাচনেও তার রাজনৈতিক প্রভাব পড়তে পারে।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
বিরোধী দলগুলিও এই ইস্যুকে হাতিয়ার করেছে। বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেস বারবার প্রশ্ন তুলেছে, কেন রাজ্য সরকার সাধারণ মানুষের করের টাকা প্রকল্পে খরচ করছে, অথচ কর্মচারীদের বেতন ঠিকমতো দিচ্ছে না?
বিরোধী শিবির বলছে, রাজ্য সরকার যদি আদালতের রায় মানতে না পারে, তবে এটি আইনের অবমাননা।
পশ্চিমবঙ্গের ডিএ মামলা এখন শুধুমাত্র আর্থিক বা প্রশাসনিক ইস্যু নয়, এটি এক সামাজিক, নৈতিক ও রাজনৈতিক প্রশ্নে পরিণত হয়েছে। একদিকে হাজার হাজার সরকারি কর্মচারীর ন্যায্য দাবি, অন্যদিকে এক অদ্ভুত প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা। আদালতের রায় স্পষ্ট হলেও বাস্তবায়নের অভাবেই সমস্যা থেকে যাচ্ছে।
এই প্রতিবেদন থেকে যা স্পষ্টভাবে উঠে আসছে তা হলো — রাজ্য সরকার যতদিন না আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়ন করে, ততদিন এই বিতর্ক চলবে এবং কর্মচারীদের আন্দোলনও থামবে না।
প্রশ্ন ১: বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে ডিএ কত শতাংশ?
উত্তর: বর্তমানে রাজ্য সরকার ৩-৪% ডিএ দিচ্ছে, যা কেন্দ্রীয় হারের তুলনায় অনেক কম।
প্রশ্ন ২: আদালত ডিএ বিষয়ে কী বলেছে?
উত্তর: আদালত বলেছে ডিএ কোনো দয়া নয়, এটি কর্মচারীদের অধিকার।
প্রশ্ন ৩: রাজ্য সরকার কেন ডিএ দিচ্ছে না?
উত্তর: সরকারের দাবি, রাজস্ব ঘাটতির কারণে তারা পুরো হারে ডিএ দিতে পারছে না। তবে অর্থনীতিবিদ ও কর্মচারীরা এই যুক্তি মানছেন না।
প্রশ্ন ৪: কর্মচারীরা কী পদক্ষেপ নিচ্ছে?
উত্তর: তারা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। অগাস্টে বৃহৎ কর্মবিরতির সম্ভাবনা রয়েছে।