পশ্চিমবঙ্গের ডিএ (মহার্ঘ্য ভাতা) বিতর্ক বিগত কয়েক বছর ধরেই রাজ্যের সরকারি কর্মচারীদের এক গভীর অসন্তোষের কেন্দ্রে রয়েছে। ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত এসে পরিস্থিতি এক চরম উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছেছে। কলকাতা হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে একাধিক শুনানি, রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবায়নে গড়িমসি — সবকিছু মিলিয়ে রাজ্যের চাকরিজীবীদের মধ্যে এক প্রবল ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। কনফেডারেশন সহ বিভিন্ন কর্মচারী সংগঠন আবারো নতুন কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দিয়েছে, আর তা রাজ্য প্রশাসনের উপর নতুন করে চাপ তৈরি করেছে।

কী নিয়ে এই মামলা? — মূল বিষয়বস্তু

ডিএ মামলার মূল বিষয় হল, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কর্মচারীদের কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘ্য ভাতা না দেওয়া। যেখানে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীরা ৪৬% হারে ডিএ পাচ্ছেন, সেখানে রাজ্য সরকার এখনো মাত্র ৩-৪% হারে ডিএ প্রদান করছে। কর্মচারীদের অভিযোগ, এটি সরাসরি বৈষম্যমূলক আচরণ এবং সংবিধানবিরোধী।

২০১৬ সালে এই বিষয়ে প্রথম মামলা দায়ের করা হয় এবং ২০২২ সালে কলকাতা হাইকোর্ট রায় দেয় যে, ডিএ হচ্ছে ‘কোনো দয়া নয়, এটি কর্মচারীদের অধিকার’। কিন্তু সেই রায় কার্যকর করতে রাজ্য সরকার নানা অজুহাত দেখিয়ে বিলম্ব করে চলেছে।

আদালতের অবস্থান ও রাজ্যের টালবাহানা

কলকাতা হাইকোর্ট এবং পরবর্তীতে সুপ্রিম কোর্ট বারবার রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে ডিএ নিয়ে স্বচ্ছতা বজায় রাখার এবং কেন্দ্রীয় হারে ডিএ প্রদানের দিক নির্দেশনা নিতে। কিন্তু রাজ্য সরকার প্রতিবারই অর্থনৈতিক সংকট, কোভিড পরিস্থিতি এবং অন্যান্য প্রশাসনিক সমস্যার অজুহাতে এই নির্দেশকে কার্যকর করছে না।

২০২৫ সালের মে মাসে আবারো সুপ্রিম কোর্টে এই মামলার শুনানি হয়। আদালত রাজ্যকে জানায়, তারা যদি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে ডিএ প্রদান সংক্রান্ত রূপরেখা না দেয়, তবে আদালত কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে।

তবে আশ্চর্যের বিষয়, এত কিছুর পরও এখনো পর্যন্ত রাজ্য সরকার একটি নির্দিষ্ট রূপরেখা আদালতে পেশ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

ডিএ-তে পিছিয়ে পশ্চিমবঙ্গ, অন্য রাজ্যের তুলনা

রাজ্যডিএ শতাংশ (২০২৫)মন্তব্য
পশ্চিমবঙ্গ৩%-৪%রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় হারে মানে না
মহারাষ্ট্র৪৬%কেন্দ্রীয় হারে ডিএ প্রদান
বিহার৪৬%কেন্দ্রের সাথে তাল মিলিয়ে চলা
কেরল৪৫%প্রতি ছয় মাস অন্তর ডিএ সমন্বয়
উত্তরপ্রদেশ৪৬%কেন্দ্রীয় নিয়ম অনুসরণ

এই তালিকাটি স্পষ্ট করে দেয়, রাজ্য সরকার যে ‘অর্থ নেই’ বলে যে ব্যাখ্যা দিচ্ছে তা আদৌ যুক্তিসম্মত নয়। অনান্য রাজ্য যারা পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তারাও কেন্দ্রীয় হারে ডিএ প্রদান করতে পারছে।

কর্মচারীদের বক্তব্য ও আন্দোলনের রূপরেখা

রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের একাধিক সংগঠন যেমন কনফেডারেশন অব স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ, সরকারি কর্মচারী ফেডারেশন, ও ডিএ সংগ্রামী মঞ্চ বারবার দাবি জানিয়ে আসছে যে, রাজ্য সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে কেন্দ্রীয় হারে ডিএ দিচ্ছে না।

২০২৫ সালের জুলাই মাসে কনফেডারেশন এক সাংবাদিক সম্মেলনে জানায়:

“আমরা দীর্ঘ ছয় বছর ধরে ডিএ-এর জন্য লড়াই করছি। আদালতের রায় আমাদের পক্ষে, কিন্তু রাজ্য সরকার অসাংবিধানিকভাবে আমাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। অগাস্টে আমরা বৃহত্তর কর্মবিরতি ও ধর্ণার প্রস্তুতি নিচ্ছি।”

তাদের মতে, এই আন্দোলন শুধু আর্থিক অধিকার নয়, বরং ন্যায়ের দাবিতে এক সম্মিলিত প্রতিবাদ।

অর্থনৈতিক বাস্তবতা বনাম প্রশাসনিক ব্যাখ্যা

রাজ্য সরকারের বক্তব্য হলো, তারা রাজস্ব ঘাটতির মধ্যে রয়েছে এবং এত বড় অঙ্কের ডিএ একসাথে দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, যেখানে রাজ্য নানা রাজনৈতিক প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে, সেখানেই বা কর্মচারীদের ন্যায্য পাওনা কেন আটকে রাখা হচ্ছে?

বিভিন্ন অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, ডিএ মূলত কর্মচারীদের খরচ সামলানোর জন্য দেওয়া হয়, এটি বিলাসিতা নয়। তাই এটি না দিলে কর্মদক্ষতায় প্রভাব পড়ে এবং প্রশাসনিক কাঠামো দুর্বল হয়।

ভবিষ্যতের সম্ভাব্য দিক

ডিএ মামলার ভবিষ্যৎ পুরোপুরি নির্ভর করছে সুপ্রিম কোর্টের পরবর্তী রায় ও রাজ্য সরকারের অবস্থানের উপর। যদি আদালত আরও কঠোর অবস্থান নেয়, তাহলে রাজ্য সরকার বাধ্য হতে পারে ডিএ দেওয়ার রূপরেখা দিতে।

অন্যদিকে, যদি রাজ্য সরকার আবারো বিলম্ব করে, তাহলে কর্মচারীদের মধ্যে অস্থিরতা আরও বাড়বে এবং আগামী বিধানসভা নির্বাচনেও তার রাজনৈতিক প্রভাব পড়তে পারে।

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

বিরোধী দলগুলিও এই ইস্যুকে হাতিয়ার করেছে। বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেস বারবার প্রশ্ন তুলেছে, কেন রাজ্য সরকার সাধারণ মানুষের করের টাকা প্রকল্পে খরচ করছে, অথচ কর্মচারীদের বেতন ঠিকমতো দিচ্ছে না?

বিরোধী শিবির বলছে, রাজ্য সরকার যদি আদালতের রায় মানতে না পারে, তবে এটি আইনের অবমাননা।

পশ্চিমবঙ্গের ডিএ মামলা এখন শুধুমাত্র আর্থিক বা প্রশাসনিক ইস্যু নয়, এটি এক সামাজিক, নৈতিক ও রাজনৈতিক প্রশ্নে পরিণত হয়েছে। একদিকে হাজার হাজার সরকারি কর্মচারীর ন্যায্য দাবি, অন্যদিকে এক অদ্ভুত প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা। আদালতের রায় স্পষ্ট হলেও বাস্তবায়নের অভাবেই সমস্যা থেকে যাচ্ছে।

এই প্রতিবেদন থেকে যা স্পষ্টভাবে উঠে আসছে তা হলো — রাজ্য সরকার যতদিন না আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়ন করে, ততদিন এই বিতর্ক চলবে এবং কর্মচারীদের আন্দোলনও থামবে না।

প্রশ্ন ১: বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে ডিএ কত শতাংশ?
উত্তর: বর্তমানে রাজ্য সরকার ৩-৪% ডিএ দিচ্ছে, যা কেন্দ্রীয় হারের তুলনায় অনেক কম।

প্রশ্ন ২: আদালত ডিএ বিষয়ে কী বলেছে?
উত্তর: আদালত বলেছে ডিএ কোনো দয়া নয়, এটি কর্মচারীদের অধিকার।

প্রশ্ন ৩: রাজ্য সরকার কেন ডিএ দিচ্ছে না?
উত্তর: সরকারের দাবি, রাজস্ব ঘাটতির কারণে তারা পুরো হারে ডিএ দিতে পারছে না। তবে অর্থনীতিবিদ ও কর্মচারীরা এই যুক্তি মানছেন না।

প্রশ্ন ৪: কর্মচারীরা কী পদক্ষেপ নিচ্ছে?
উত্তর: তারা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। অগাস্টে বৃহৎ কর্মবিরতির সম্ভাবনা রয়েছে।

By BT SOLUTIONS

BT SOLUTIONS IS AN ONLINE TECH NEWS WEBSITE.IN THIS PORTAL WE REGULARLY UPDATES TECH RELATED ANY ARTICLES.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *